| বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
ছবি : সংগৃহীত
ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ বিপজ্জনক মোড় নিতে যাচ্ছে। নেতানিয়াহুকে ট্রাম্পের সমর্থন এবং কানাডায় জি ৭ নেতৃবৃন্দ ইসরাইয়েলের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরো সংকটজনক করে তুলেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জি-৭-এর বৈঠক শেষ না করেই হোয়াইট হাউজে ফিরে যান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কাউন্সিলের বিশেষ বৈঠকের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেন। একই সাথে ইসরাইলের সুরে সুর মিলিয়ে তেহরান খালি করার নির্দেশনা জারি করেন।
ইসরায়েল ও ট্রাম্পের মূল লক্ষ ইরানে বিপ্লবোত্তর সময় থেকে চলে আসা ইসলামী শাসনের অবসান এবং ইরানকে বেসামরিক উদ্দেশ্যেও পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হতে না দেওয়া। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে বিগত ৭৮ বছর যাবত ইসরায়েল যে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করার পরও ফিলিস্তিনের আরব প্রতিবেশি দেশগুলোর ইসরায়েল প্রীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে কার্যত ইসরায়েলের কোনো শত্রু নেই। ফিলিস্তিনিদের সর্বতোভাবে সহায়তাদানকারী ইরানকে ওই অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী দেশ ইরানের কোমর ভেঙে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা চালানোর দু:সাহস দেখিয়েছে। ইরানকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে ইসরায়েল ইরানের প্রেসিডেন্ট, কয়েকজন জেনারেল, পরমাণু বিজ্ঞানিকে হত্যা করেছে। ইরানে অবস্থানকালে হত্যা করেছে হিজবুল্লাহ ও হামাস নেতাকে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনিকে হত্যার জন্য তাদের চেষ্টার শেষ নেই। পলাতক ইরান শাহের পুত্র প্যারিসে বসে স্বপ্ন দেখছেন যে তিনিই হতে যাচ্ছেন ইরানের পরবর্তী শাসক। সেজন্য তিনি তার নিজ দেশের ওপর ইসরায়েলের হামলাকে সমর্থন জানিয়ে ইরানের শাসকমহলকে উৎখাতের এখনই উপযুক্ত সময় বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বলে চলেছেন।
তবে সর্বশেষ ঘটনাবলিতে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, পরিস্থিতির আরো অবনতি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটতে পারে। ইসরাইলের একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু এবং ইরানি নেতৃত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় নির্মূল করার আয়োজন যে অনেক গভীর সেটি ইরানি নেতত্বের¡ উপলব্ধি না করার কথা নয়। আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এক ভাষণে দেশের জন্য তিনি শাহাদতবরণ করলেও ইসলামী বিপ্লব এবং ইরানি জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার এজেন্ডা এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বিপজ্জনক উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়ে চীন সতর্ক করে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। নেতানিয়াহু ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিশেষভাবে প্রয়োজন। নেতানিয়াহু সবশেষ মন্তব্যে তার নতুন লক্ষ্য ইরানে বর্তমান শাসকদের বিদায় করে নতুন শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। এ লক্ষ্যে ইরানিদের প্রতি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে তেহরানে একটি গোপন ড্রোন তৈরির কারখানা আবিষ্কার করেছে ইরানি পুলিশ। এ কারখানায় মোসাদের তত্ত্বাবধানে ইরানে নাশকতা সৃষ্টির জন্য ড্রোন তৈরি করা হতো। ইসরাইল যুদ্ধের প্রথম দিনে ছয় জেনারেল এবং সমসংখ্যক পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যার পিনপয়েন্ট টার্গেট ইরানি ভূখণ্ড থেকেই করা হয়েছিল। যুদ্ধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে বিভিন্ন সামরিক ও সরকারি স্থাপনায় আঘাত হানতে বিমানের পরিবর্তে ড্রোন ব্যবহার করা হয়।
ইরানি ভূখণ্ডের ভেতরে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর চরদের দিয়ে এসব হামলা চালানো হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। তবে ইরানের ভেতর থেকে ইসলামী শাসনের বিরুদ্ধে একটি পক্ষ সক্রিয় রয়েছে, যারা ইসরায়েলকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে। জানা যায় যে, ইরানের বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কয়েকটি পক্ষ সক্রিয়, যাদের কার্যক্রমে এসব শক্তি বাইরে থেকে ইন্ধন দিয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি শক্তি রয়েছে পাহলভি রাজাদের অনুগত ইরানি, দ্বিতীয় পক্ষটি হলো মুজাহিদীনে খালক বা কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থিত ইরানি, যারা শুরু থেকেই ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতা চালিয়ে আসছিল। তৃতীয় পক্ষটি হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী, যার একটি অংশ পূর্বে সিস্তান প্রদেশের বালুচ এবং অন্য অংশ পশ্চিমাঞ্চলের কুর্দিরা। এ তিনটি পক্ষকে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা অব্যাহতভাবে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে বর্তমান শাসনের পরিবর্তনের জন্য। ইসরায়েল ও তার মিত্রদেশগুলো ইরানের পাল্টা হামলার প্রচণ্ডতা সম্পর্কে আগাম ধারণা করতে পারেনি।
ইরান এ প্রত্যাঘাত যদি আরো কয়েক দিন অব্যাহত রাখতে পারে তাহলে ইসরাইল এবারকার মতো তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিরতি টেনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু করতে পারে। মিত্রদের দিয়ে যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইল তখনই যাবে যখন মনে করবে যে, এ যাত্রায় ইরানে শাসন পরিবর্তনের এজেন্ডা পূরণ করা সম্ভব নয়। আবার একই সাথে ইসরাইলের অস্তিত্বের সামনে হুমকি তৈরি হবে।
ইসরাইলের পরিকল্পনার মূলে রয়েছে বৃহত্তর ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা। এ লক্ষ্য অর্জনে গত আড়াই দশকের বেশি সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের বড় দেশগুলোকে দুর্বল করা হয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে দিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে ৯ বছর সেই যুদ্ধ চালিয়ে রাখা হয়েছে। এতে দুই দেশই দুর্বল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর কুয়েত দখলের উনকানি দিয়ে ইরাককে দুর্বল করার ব্যবস্থা করা হয়। সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে সেটি সম্পন্ন হয়। এরপর আরব বসন্তের মাধ্যমে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়া হয়।
মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন ও হত্যার পর লিবিয়াকে কার্যত তিনভাবে বিভক্ত করা হয়। গৃহবিবাদে বিপর্যস্ত হয় ইয়েমেন ও সিরিয়া। আর সেই সাথে আরবের পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর ওপর ইসরাইলকে স্বীকৃতিদানের চাপ তৈরি করা হয়। এর মধ্যে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরাইলের আগ্রাসী সঙ্ঘাত আরম্ভ হয়। এর একপর্যায়ে ইরানের প্রতিরোধ শক্তিগুলোকে দুর্বল করে চূড়ান্ত আঘাত করা হয় ইরানের ওপর। নেতানিয়াহু এ যুদ্ধ শুরু করার আগেই ঘোষণা করেছেন, তাদের পরবর্তী টার্গেট হবে পাকিস্তান। তুরস্ককে নিশানা করার বিষয়টিও আড়ালে থাকেনি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর। তিনি এক দিকে একের পর এক যুদ্ধ বাধিয়ে নিজের ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চান। অন্য দিকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ইসরাইলের আধিপত্যবন্দী করে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করতে চান।
Posted ১২:৪২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh